গরম নিয়ে হই চই গোটা দেশ । বিদ্যালয়সমূহ খোলা রাখা বা বন্ধ রাখা নিয়ে নানা মত নানা চিন্তা অবিরত। বিদ্যুতের ঘাটতিতে হাজারো মন্তব্য ওড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে। লোডশেডিং নিয়ে আক্রমানত্মক কথার শেষ নেই। ফ্যান-লাইটের আলো-বাতাস না পেয়েও বিল পরিশোধে কমতি নেই। সবই আমাদের ভোগান্তির এক ক্রান্তিকাল বলে দেশে এখন ঝড়োহাওয়া বইছে। গরম নিয়ে সত্যিকারের কথা কেউ বলছেনা।
গরম তো মানুষ রচনা করছেনা। এতে মানুষের কোনো হাত নেই। আবহমান কাল থেকে চলে আসছে এমন মৌসুমী ধারা। শীত আসে গরমও আসে। তা ফের চলে যায় আবার সময়ের চক্রাকারে নির্দিষ্ট নিয়মে ফিরে আসে। তা চলবে জগতের শেষ আয়ু পর্যন্ত। আগে গরম নিয়ে কোনো রাজা-বাদশাহর প্রতি কোনো অভিযোগ ছিলোনা। কারন তখন রাজা কর্তৃক প্রজাদের বাতাস খাওয়ানোর কোনো ব্যবস্তাই ছিলোনা বলে মানুষ নিজের চেষ্টায় গরমে মৌসুমে বাতাসের ব্যবস্থা করেছে।
অনাধুনিক সময়ে বাতাস ব্যবস্থাপনায় হাতপাখাই ছিলো প্রতিটি মানুষের শরীর জুড়িয়ে রাখার প্রধান উপায়।
তখন বন-জঙ্গল ও পথে-প্রান্তরে গাছ-গাছালির ছিলো পর্যাপ্ত উপস্থিতি। আবহাওয়া ছিলো বেশ মানানসই।
তবে কালের পরিবর্তনে মানব জ্ঞানের উন্মেষ হওয়ায় আরামদায়ক মাটি-ছনের ঘরের পরিবর্তে এখন পাকা ঘরের ব্যবস্থা করেছে অনেকেই।
ঝাঁড়-জঙ্গল কেটে পরিস্কার করে মানুষ গড়ে তুলেছে নগর। যে গ্রাম ছিলো গাছে গাছে ভরা সেই গ্রামেও এখন ছোঁয়া লেগেছে আধুনিকতা তথা গাছ কেটে নগর সাদৃশ্য বাড়িঘর করার।
ফলে অক্সিজেন ও তাপমাত্রার ভারসাম্যহীনতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছি আমরা। আমাদের আরামদায়ক তাপমাত্রার উপভোগের স্থলে এখন কভু প্রচন্ড শীত, কভু অতিশয় গরম যেন আমাদের জীবনকে করে তুলছে অতিশয় দূর্বিসহ। যা আমাদের অর্জন, আমাদের কামাই।প্রকৃতিনির্ভর মন-মানসিকতাকে নির্বাসন দিতে হয়েছে বিজ্ঞানের অজুহাতে। কিন্তু প্রকৃতিতেও বিজ্ঞান ছিলো বা বিজ্ঞান আছে তার কোনো ক্যাকুলেশন আমরা কখনও করিনি। মহান স্রষ্টার প্রজ্ঞাময় কৌশলকে বিনা ক্যালকুলাশনে আমরা বিনাশ করার অভিপ্রায়ে মত্ত রয়েছি। আর তাই উজাড় হচ্ছে বন-জঙ্গল ও গাছ-গাছালি। আমরা ভাবছি গাছ-গাছড়া কেটে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এক শহর অপরিহার্য। গ্রামও এমন হওয়া উচিত। এজন্য আমরা প্রাকৃতিক পরিবেশ বিলুপ্ত করে মানব প্রসূত নগরায়ন উপহার দিয়ে উৎফুল্লতা প্রকাশ করছি। প্রাকৃতিক পরিবেশের নির্ভরতাকে আমরা ভাগ্যবিশ্বাসী বলে উপহাস করছি। তাই এর পরিবর্তন কামনায় উদ্বেলিত হয়ে সবুজাভ পরিবেশ উৎখাত করে এখন আমরা চরম গরমে উৎকন্ঠা প্রকাশ করছি।
গরম নিয়ন্ত্রণের ভার এখন আমাদের হাতে। হাতপাখা এখন অচল। বৈদ্যুতিক পাখা এখন ঘরে ঘরে। যার রিমোট কন্ট্রোল মানুষের হাতে। বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা করা যদি বিদ্যুৎ দেয় তবে ফ্যান চলে, এসি চলে, ফ্রিজ চলে। আর যদি ব্যবস্থাকরা তা না দেয় তবে ফ্যান-এসি-ফ্রিজ অচল। গরম থেকে রক্ষা পেতে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণকারীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। মোট কথা গরম থেকে রক্ষায় এখন প্রকৃতি নির্ভর থেকে মানুষ নির্ভর হয়ে পড়েছি। কালের পরিক্রমায় আমাদের ব্রেন-মগজ অনেকটাই সতেজ হয়েছে সবজায়গায় বিজ্ঞান খুঁজি ও তার নিয়ন্ত্রণ নেবার প্রতিযোগিতায় নামি। মানুষ এতে অনেকটা সফলও হয়েছে। তাই আমরা যেমন সৃষ্টিকর্তার নির্ভরতা ছেড়ে দিয়ে মানুষ মানুষের ওপর নির্ভর হয়েছি, তেমনি আজ গরমের দুঃসহ যাতনায় একটু প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে নিয়ন্ত্রক মানুষের আশায় হাওয়া খেতে হ্যাঁ করে বসে থাকি। বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কারীর শক্তি কতটুকু আছে কে জানে? তা জেনেও আমরা গরমের কারণে চিৎকার করি, হই চই করি। যে আরামদায়ক শীতল পরিবেশকে আমরা নিজেরাই তাড়া করেছি ও গরম টেনে এনেছি তাতে আমাদের কোনো চেতন্য ফিরে আসছেনা। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে আমাদের কৃতকর্মের জন্য। তাই গরম আমাদের অর্জন। তা ভূগতে হবে। হইচই করে লাভ নেই। যদি পারেন আগের মতো গা-গাছালির দৃশ্য ফিরিয়ে আনুন। পরিবেশের ভারসাম্য ফিরে আসুক।
Leave a Reply